Sunday, December 13, 2009

মার্কিন প্রেসিডেণ্ট বারাক ওবামা

যুদ্ধের আগুনে ভারত সীমান্ত নতুন করে উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেণ্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তানে যুদ্ধ জোরালো করে তুলবেন, সে যুদ্ধ প্রসারিত করবেন পাকিস্তানেও। তঁার নবঘোষিত আফপাক সমরনীতির অঁাচ ভারতকে পোহাতে হবেই।

আমেরিকা আট বছর ধরে যুদ্ধ চালাচ্ছে আফগানিস্তানে। সে যুদ্ধে চূড়ান্ত জয় বা চূড়ান্ত পরাজয় কোনওটাই হয়নি। শুধু আফগানিস্তানেই যুদ্ধ সীমাবদ্ধ রাখলে কোনও দিনই আমেরিকার পক্ষে জয়লাভ সম্ভব হবে না–প্রেসিডেণ্ট ওবামা ক্ষমতায় এসেই তা বুঝেছিলেন। সে জন্যই তিনি ওই Öুদ্ধের সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়িয়ে, তঁার আফপাক নীতি ঘোষণা করেছিলেন। সে নীতি সফল হয়নি বলেই ২ ডিসেম্বর ওবামা তঁার নতুন নীতি ঘোষণা করেছেন।

তঁার আগের আফপাক নীতিতেও ভারতের কথা ছিল না, এ বারও নেই। কিন্তু, আফগানিস্তানে ভারতের কয়েক হাজার সৈন্য মোতায়েন আছে, বিরাট আকারের গঠনমূলক কাজও সেখানে ভারত করছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার দাবি আমেরিকাতে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সি প্রেসিডেণ্ট ওবামাকে জানিয়েছিলেন, ভারত আফগানিস্তান থেকে নড়বে না। সেখানে যে কাজ ভারত শুরু করেছে, তা চালিয়ে যাওয়া হবেই।

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিয়ের এই কথায় প্রেসিডেণ্ট ওবামা মনোবল পেয়েছেন। সে জন্যই আফগানিস্তানে যুদ্ধ আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পেরেছেন। সেখানে ৬৮ হাজার আমেরিকান সৈন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ, যথা িব্রটেন, ফ্রন্স, ইতালি ইত্যাদিও সেনা পাঠিয়েছে। তারা একযোগে তালিবানের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু, আফগানিস্তানে ভারতীয় সৈন্যরা যুদ্ধ করছে না। তারা শুধু ওই দেশে গঠনমূলক কার্যে নিযুক্ত ভারতীয় অসামরিক কমর্ীদের নিরাপত্তার দায়িেত্ব আছে।

কিন্তু, গঠনমূলক কাজও যুদ্ধের অঙ্গ। সেই হিসাবে আফগানিস্তানে ভারত আমেরিকার সহযোগী। এ জন্যই প্রেসিডেণ্ট ওবামা তঁার নতুন আফপাক নীতি নির্ধারণের আগে মনমোহন সিয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। পাকিস্তান তাতে ক্ষুব্ধ

আফগানিস্তানে ভারতের সহযোগিতার গুরুত্ব কতটা, তা আমেরিকা বোঝে। ২০০৬ সালের শেষ দিকে দু’ জন আমেরিকান সেনাকর্তা, জেনারেল ডেভিড পেট্রাইউস এব জেনারেল জেমস এফ অ্যামোস ‘‘আর্মি/মেরিন কোর ফিল্ড ম্যানুয়াল ৩২৪’’ নামে একখানি বই প্রকাশ করেন। সে বইয়ে আফগানিস্তানে ও ইরাকে পুরানো যুদ্ধনীতি পালটে কোন নতুন যুদ্ধনীতি নিতে হবে, তা বিশদভাবে আলোচনা করেছিলেন। আমেরিকা ওই নতুন নীতি গ্রহণ করেছে।

আফগানিস্তানে শুধু যুদ্ধের দ্বারা শত্রুকে পরাস্ত করা যাবে না, এই হল পেট্রাইউসঅ্যামোসের যুদ্ধাভিজ্ঞতার নির্যাস। তঁারা বলেছেন, যুদ্ধ চালাতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে আফগানদের মন জয়ও করতে হবে। উত্তম প্রশাসন দিতে হবে, রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাত্ম গড়তে হবে। আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হবে ইত্যাদি।

এই নয়া নীতিকে বলা হয়েছে Comprehensive Counter-insurgency (COIN) বা সর্বাঙ্গীণ বিদ্রোহবিরোধিতা। ওবামা ক্ষমতায় এসেই এই নয়া যুদ্ধনীতি মেনে নিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত তঁার মত পালটায়নি। কিন্তু, তঁার প্রশাসন বলছে, আফগানিস্তানে একই সঙ্গে যুদ্ধ চালানো ও গঠনমূলক কাজ করে যাওয়া–তাও বছরের পর বছর–আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, আমেরিকার অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর সব চেয়ে ঋণী দেশ এখন আমেরিকা। কত ব্যয়ভার তারা বইতে পারে?

আফগানিস্তানে ভারত গঠনমূলক কাজের দায়িত্ব বহন করছে সানন্দে। এ ব্যাপারে পাকিস্তান বা অন্য কোনও দেশের সহযোগিতা আমেরিকা পায়নি। মনমোহন সি ওয়াশিটনে গিয়ে প্রেসিডেণ্ট ওবামাকে জানিয়েছেন, ভারত আফগানিস্তানে জনকল্যাণমূলক কাজ থেকে সরে আসবে না। ওবামা তাতে আশ্বস্ত হয়েছেন।

কিন্তু, পাকিস্তান হয়েছে অতিশয় ক্ষুব্ধ। কেননা, আফগানিস্তানে তাদের দূতাবাস ছাড়া আর কিছু নেই। সেখানে তাদের সৈন্য নেই, অন্য কাজকর্মও নেই। অন্য দিকে, ভারতের আছে ব্যাপক উপিস্থতি। তাই ক্রোধবশত তারা দু’ বার কাবুলে অবিস্থত ভারতের দূতাবাস আক্রমণের ব্যবস্থা করেছিল। তা ছাড়াও, ভারত বেলুচিস্তানে বিদ্রোহের উসকানি দিচ্ছে, বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দিচ্ছে, এই নালিশ বার বার জানাচ্ছে পাকিস্তান। তাদের প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেছেন, আফগান সীমান্ত থেকে বিদ্রোহী বালুচদের ভারত সাহায্য দিচ্ছে, সে সম্পর্কে তথ্য ও প্রমাণ তঁারা পেয়েছেন। তঁারা নাকি উপযুক্ত সময়ে সে সব প্রমাণ করবেন। তবে আপাতত করবেন না।

ভারতের এবিম্বধ ষড়যন্ত্রের সাক্ষ্য ও প্রমাণ প্রকাশ করতে পাকিস্তান কুিণ্ঠত কেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। তবে, ওবামা প্রশাসন পাকিস্তানের এই অভিযোগকে ফঁু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।

কয়েক জন উচ্চ পদস্থ আমেরিকান ওবামাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, আফগানিস্তানে ভারতের উপিস্থতির অবসান ঘটানো দরকার, কেননা, পাকিস্তান তাতে খুশি হবে না। অথচ, সন্ত্রাসবাদ দমনের ব্যাপারে পাকিস্তান আমেরিকার মিত্রশক্তি। মিত্রের মন জোগাতে আফগানিস্তান থেকে ভারতকে পাততাড়ি গোটানোর নির্দেশ দিতেই হবে।

প্রেসিডেণ্ট ওবামা এই পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছেন। আমেরিকার উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা আরও পরামর্শ দিয়েছিলেন, কাশ্মীর থেকে ভারতীয় ফৌজ সরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে হবে। কেননা, পাকিস্তানের মনস্তুিষ্টর জন্য সেটা প্রয়োজন। প্রেসিডেণ্ট ওবামা এই পরামর্শও প্রত্যাখ্যান করেছেন। কাশ্মীর সমস্যার ব্যাপারে আমেরিকা কোনও রকম হস্তক্ষেপ করবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।

কিন্তু, পাকিস্তানে তিনি ঢেলে অর্থ ও অস্ত্র দিচ্ছেন। ভারত তাতে ক্ষুব্ধ। কারণ, পাকিস্তান অত্যাধুনিক যে সব অস্ত্র আমেরিকার কাছ থেকে আজ পর্যন্ত পেয়েছে, সে সব তারা ভারতের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছে। এমনকী, কারগিল যুদ্ধেও তারা আমেরিকান অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল।

ভারতের আপত্তি সেত্ত্বও পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র জোগানো থেকে আমেরিকা বিরত হবে না। বর, ওবামা ঘোষণা করেছেন, তিনি পাকিস্তানকে আরও বেশি ডলার দেবেন। তঁার শর্ত শুধু একটাই–পাকিস্তান থেকে তালিবান ও অন্য জঙ্গি সগঠনগুলিকে নিিশ্চহ্ন করে দিতে হবে।

পাকিস্তান এই শর্ত কিছুটা মানতে বাধ্য হয়েছে। তারা তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। তারা ওই যুদ্ধ চালাচ্ছে ওয়াজিরিস্তানে তথা আফপাক সীমান্ত ঞ্চলে। তালিবানের কিছু লোকজন তাতে মারা গিয়েছে বটে, কিন্তু পাক জওয়ানরাও প্রাণ হারিয়েছে। এ ভিন্ন অন্য ফল মেলেনি।

কারণ, আফগান সীমান্ত এলাকা থেকে তালিবানরা চলে এসেছে পাকিস্তানের অন্যান্য জায়গায়। ওই সীমান্ত এলাকায় েড্রান বিমানের সাহায্যে আমেরিকা বোমা বর্ষণ করছে। সে জন্যও ওই এলাকা ছেড়ে অন্যান্য এলাকায় আশ্রয় নেওয়া তালিবানদের দরকার ছিল।

যেমন, তালিবান নেতা মোল্লা ওমর দলবল সহ কোয়েটা এলাকায় বাস করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি আফগানিস্তানে অপারেশন চালাচ্ছিলেন। এখন আমেরিকান েড্রান থেকে বালুচিস্তানের ওই এলাকায় বোমা ফেলা হচ্ছে বলে মোল্লা ওমর করাচিতে এসে উঠেছেন। করাচি পাকিস্তানের বন্দর নগরী তথা প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। আমেরিকা আফগান যুদ্ধের জন্য রসদ পাঠায় করাচি বন্দর দিয়ে। অতি জনবহুল ওই নগরীর পর বোমা বর্ষণ করা চলে না। তাই আফগান তালিবানদের পক্ষে করাচি একটা নিরাপদ স্থান।

আমেরিকা আফগানিস্তানে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে, অথচ তাদের প্রধান নেতা মোল্লা ওমর সদলে করাচিতে ঘঁাটি গেড়ে বহাল তবিয়তে আছেন! পাকিস্তানের এই দু’মুখো নীতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমেরিকার চাপে তারা পাকিস্তানের তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, কিন্তু, আফগানিস্তানের তালিবানদের তারা মদত দিচ্ছে। উপরন্তু, পাকিস্তানে তালিবান ছাড়া আরও যে সব জঙ্গি সগঠন আছে, যথা ত্মস্করইতোইবা, জয়েশইমহম্মদ ইত্যাদি, তাদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না পাক সরকার। এটাই পাকিস্তানের দু’মুখো নীতি।

প্রেসিডেণ্ট ওবামা পাকিস্তানের দু’মুখো নীতি সম্পর্কে অবহিত। তিনি তঁার নতুন আফপাক নীতি ঘোষণা করে মঙ্গলবার ওয়েস্ট পয়েণ্টের মার্কিন মিলিটারি অাকাদেমি থেকে ৩৩ মিনিটের যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে বলেছেন, পাকিস্তান হল সন্ত্রাসবাদের এপিসেণ্টার। আফগানিস্তানে ৬৮ হাজার আমেরিকান সৈন্য থাকা সেত্ত্বও প্রেসিডেণ্ট ওবামা আরও ৩০ হাজার সৈন্য সেখানে পাঠাবেন। কিন্তু, তারা কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে পাকিস্তানের পর। কারণ, আফগানিস্তানের তালিবানদের নিরাপদ আশ্রয় জোগায় পাকিস্তান। পাক ভূমি থেকেই তালিবানরা আফগানিস্তানে অপারেশন চালায়। আফগানিস্তানের তালিবানদের সৃিষ্ট হয়েছিল পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলিতে। তাদের লালন পালন করেছে পাক সেনাবাহিনী। সেই ঐতিহ্য এখনও চলছে।

ওবামা বলেছেন, তিনি যখন আফপাক নীতি ঘোষণা করছেন, ঠিক সে সময়েই পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে হামলা চালানো হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ পাকিস্তানকে ক্যানসারের মতো আক্রমণ করেছে। সে জন্য অেস্ত্রাপচার প্রয়োজন। ওবামা মুখে বলেননি, কিন্তু, পাকিস্তানে অেস্ত্রাপচারের ব্যবস্থা তিনি করেছেন। আফগানিস্তানের পাশাপাশি পাকিস্তানেও যুদ্ধ চলবে। তবে, সেখানে আমেরিকান সৈন্য পাঠানো হবে না। সেখানে অদৃশ্য যুদ্ধ চালাবে সি আই এ। আর, আকাশপথে আক্রমণ করবে েড্রান বিমান।

আফগান যুদ্ধের পাশাপাশি পাকিস্তানেও যুদ্ধ চালানো হবে, কারণ, পাকিস্তানেই রয়েছে সন্ত্রাসবাদের মূল ঘঁাটি। ওবামা আফগানিস্তানের চেয়ে পাকিস্তানকে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। কেননা, পাকিস্তানে রয়েছে পারমাণবিক অেস্ত্রর ভাণ্ডার। আলকায়েদা ও তালিবান ওই ভাণ্ডার দখল করতে পারলে বিেশ্বর পক্ষেই মহাবিপদ দেখা দেবে। আমেরিকা হবে আলকায়েদার প্রধান টার্গেট। তাই, ওবামা প্রশাসন আফগানিস্তান নিয়ে যতটা চিিন্তত, তার চেয়ে অনেক বেশি দুিশ্চিন্তত পাকিস্তান নিয়ে।

প্রেসিডেণ্ট ওবামা নতুন আফপাক নীতি ঘোষণা করায় পাকিস্তান ততোধিক দুিশ্চন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের সামরিক কর্তারা ওবামার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ। আফগানিস্তানে নতুন করে সৈন্য পাঠানোর বিরোধিতা করেছেন তঁারা। পাকিস্তানে সি আই এর কার্যবৃদ্ধিও তঁাদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।

তা ছাড়া, ওবামা বার বার বলেছেন, তিনি পাকিস্তানকে সাহায্য দানের পরিমাণ তিন গুণ বাড়াচ্ছেন বটে, কিন্তু ব্ল্যাক চেকে তিনি সই করবেন না। অর্থাৎ, তিনি যে সব শর্ত দিয়েছেন, পাকিস্তান তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে কি না, তা দেখে তিনি ডলার পাঠাবেন। নিশর্ত দান হবে না। আমেরিকা চোখ বুজেও থাকবে না।

তাই, আমেরিকার নতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা শুধু আফগানিস্তানকে নিয়েই নয়, পাকিস্তানকেও সমানভাবে জড়িত করা হয়েছে ওই পরিকল্পনায়। এমনকী, আফগানিস্তানের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানকে।

আমেরিকার এই নয়া পরিকল্পনা ভেেস্ত দিতে পাকিস্তান নানা পরিিস্থতি সৃিষ্ট করতে পারে। চীনের সহযোগিতায় তারা ভারত সীমান্তকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। ভারতের বিরুদ্ধে চীনপাকিস্তানের যৌথ আক্রমণের কথা ভেবে ভারত সরকার উদ্বিগ্ন।

প্রেসিডেিন্সর হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনবে?

সাতের দশক থেকেই ক্রমশ প্রেসিডেিন্স কলেজের স্বাতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণ করার সগঠিত আয়োজন চলেছে। সম্প্রতি প্রেসিডেিন্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপ কি প্রেসিডেিন্সহৃতগৌরব ফিরিয়ে আনবে? আলোচনা করেছেন দুই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।

অতীন্দ্রমোহন গু
( বিশিষ্ট পরিসখ্যানবিদ, প্রেসিডেিন্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক)

প্রেসিডেিন্স কলেজের বয়স প্রায় ২০০ বছর হতে চলল। ১৮১৭ সালে হিন্দ কলেজ নাম নিয়ে এর যাত্রা শুরু। তখন সেখানে পড়তে পারত শুধু হিন্দ ম্ভ্রন্ত পরিবারের পুত্র সন্তানরা। আর সেটি ছিল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ১৮৫৫ সালে এটি সরকারের হাতে চলে যায়। হিন্দকলেজের সিনিয়র অশ প্রেসিডেিন্স কলেজ নাম গ্রহণ করে, জুনিয়র অশ হয় হিন্দু স্কুল। প্রেসিডেিন্স কলেজের দরজা তখন থেকেই অন্য সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যও খুলে যায়। বহু বছর পর ১৯৪৪ সাল থেকে ছাত্রীদেরও ভরতি করা হতে থাকে। তার দীর্ঘ ইতিহাসে প্রেসিডেিন্স কলেজে নানা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই এখানে পঠনপাঠনের মান উঁচু ছিল। িব্রটিশ আমলেও যেমন, স্বাধীনতাপরবতর্ী সময়েও তেমনি, উৎকৃষ্ট শিক্ষকমণ্ডলী ও গবেষকদের কল্যাণে প্রেসিডেিন্স ক্রমে প্রাচ্যের অক্সিব্রজ হিসেবে খ্যাতিলাভ করে। কলেজের বিতর্কসভা, সেমিনার, বার্ষিক পত্রিকা– সব কিছুর মধ্যেই বিশিষ্টতার ছাপ থাকত।

প্রেসিডেিন্সর ইতিহাস বিগত শতকের সাতের দশক পর্যন্ত উত্তরোত্তর উন্নতির ইতিহাস। সাতের দশকের শেষভাগে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কলেজ কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। শাসকদলের নেতারা বলতে আরম্ভ করেন, অন্য কলেজ বিঞ্চত হবে, আর প্রেসিডেিন্স মাথা উঁচু করে থাকবে– এটা তঁাদের সমাজবাদী ধ্যানধারণাতে চলতে পারে না। দুই নেতা, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এব শিক্ষামন্ত্রী শম্ভু ঘোষ তো জোর গলায় বত্মেছিত্মেন, তঁাদের কাছে প্রেসিডেিন্স ও অন্য কলেজের স্থান একই স্তরে। তাই প্রেসিডেিন্স যেসব সুযোগসুবিধা পেয়ে এসেছে সেগুলি আেস্ত আেস্ত কমিয়ে আনা হবে।

এর প্রথম লক্ষণ দেখা গেল যখন প্রেসিডেিন্সর নামী অধ্যাপকদের অনেককে মফস্‌সলের কলেজে বদলি করা হল এবতঁাদের স্থানে অপেক্ষাকৃত নিম্ন মানের শিক্ষকদের কলেজে নিয়ে আসা হল। ফলে নামী অধ্যাপক অনেকে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন, অনেকে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। কেউ কেউ বা অপেক্ষাকৃত ভালো বেসরকারি কলেজে যোগ দিলেন। এভাবে প্রেসিডেিন্স কলেজের পঠনপাঠন অনেকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হল। নতুন অধ্যাপকরা অনেকে রাজনীতিতে বেশি সময় ব্যয় করতেন, অধ্যাপনার কাজ তঁাদের কাছে গৌণ হয়ে দঁাড়াল। প্রেসিডেিন্স কলেজের একটা বৈশিষ্ট্য হল ভরতির পরীক্ষা। তঁারা বার বার চেষ্টা করলেন, এ পরীক্ষা তুলে দেওয়ার। ছাত্রছাত্রীদের বাধা দানের ফলে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু যেটা বড় কথা প্রবীণ শিক্ষকরা নতুন শিক্ষকদের খানিকটা ভয়ের চোখে দেখতেন। স্বভাবতই প্রেসিডেিন্সর শিক্ষাগবেষণার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হল। পরীক্ষার ফল হয়তো তেমন খারাপ হল না, কারণ প্রেসিডেিন্সর ছাত্রছাত্রীদের মেধা যে আগের চেয়ে কমে গেল তা নয়। সেই মেধার জোরে এবপ্রবীণতর শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে তারা পরীক্ষায় অনেকটা আগের মতোই ভালো ফল করতে লাগল। তবে অতি সম্প্রতি এই দিকটাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে আরম্ভ করেছে। গবেষণার কাজ অনেক বিভাগে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

আমরা যারা একই সঙ্গে প্রেসিডেিন্সর প্রাক্তন ছাত্র এব শিক্ষক, তারা কলেজের দুরবস্থা লক্ষ করে চেষ্টা করেছি সীমিত ক্ষমতা নিয়ে বাধাদানের জন্য। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে, প্রচার পুিস্তকা বের করে সাধারণ মানুষকে প্রেসিডেিন্সর সকট সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়াস নিয়েছি। একবার অবসরপ্রাপ্ত অশীতিপর চার অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সুশোভনচন্দ্র সরকার, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ও ভবতোষ দত্ত আমাদের অনুরোধে প্রেসিডেিন্সর অসুবিধা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে মহাকরণে গিয়েছিলেন। জ্যোতিবাবু তঁাদের স্পষ্টই বলেছিলেন, দলের দিক থেকে বাধা আছে, তাহলেও তিনি চেষ্টা করবেন দেখতে প্রেসিডেিন্সর জন্য কী করা যেতে পারে। এতে অবশ্য অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

আমাদের দৃিষ্ট পড়েছিল ইউ জি সি’র প্রস্তাবিত অটোনমাস কলেজ ধারণাটির উপর। অটোনমাস কলেজ হলে প্রেসিডেিন্স ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে, শিক্ষকশিক্ষিকা নিয়োগে, পরীক্ষাগ্রহণ ও তার ফল প্রকাশে স্বাধীনতা পাবে। সঙ্গে সঙ্গে ইউ জি সি’র অনুদানের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। আমরা এটা নিয়ে কিছু সভাসমিতিতে বলেছি, প্রচারপুিস্তকা বের করেছি। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, আমরা বিশেষ সফল হইনি। বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন শিক্ষা সম্পর্কে যেসব প্রতিবেদন বের করেছেন যেমন, উদগঁাওকর কমিটি, গণি কমিটি, ভবতোষ দত্ত কমিশন ইত্যাদিতে অটোনমির স্বপক্ষে জোর সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেিন্সর প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের দৃিষ্টভঙ্গির বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা এটা লক্ষ করে শঙ্কিত যে অনেক বিভাগের শূন্যপদ পূরণ করার ব্যাপারে সরকার গড়িমসি করছে। উচ্চতর পদ খালি রেখে তার পরিবর্তে নিম্নতর পদে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে।

এই পটভূমিতেই সম্প্রতি প্রেসিডেিন্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। সেই ঘোষণায় আমরা আনন্দিত। বিশ্ববিদ্যালয় হলে অটোনমির সুবিধাগুলি তো পাওয়া যাবেই, তদুপরি প্রেসিডেিন্স তার কাজকর্ম প্রসারিত করার একটা বড় সুযোগ পাবে। ইউ জি সি’র কাছ থেকে অনুদান অনেক বেশি মাত্রায় পাওয়া যাবে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা যাবে। স্নাতকনিম্ন স্নাতকোত্তর উভয় দিকের পঠনপাঠন ও গবেষণায় দৃিষ্ট দেওয়া যাবে। গ্রন্থাগারের জন্য নবপ্রকাশিত বই ও জার্নাল কেনা যাবে। ন্নতি হবে ত্ম্যাবরেটরিরও।

তদুপরি সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের কাছে সব ব্যাপারে নির্ভরতা থেকে প্রেসিডেিন্স মুক্ত হবে। এখন প্রেসিডেিন্সর কোনও শিক্ষক যদি সেমিনার, সিেম্পাজিয়ামে যেতে চান– দেশেই হোক বা বিদেশেই হোক, তাহলে শিক্ষা দপ্তরের কাছে তঁাকে বারে বারে গিয়ে তদ্বির করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলে এই যন্ত্রণা ও হয়রানি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। পরীক্ষাগ্রহণ ও তার ফল ঘোষণা অনেক তাড়াতাড়ি করা যাবে।

আমরা এটা লক্ষ করে অবাক হচ্ছি যে কিছু অধ্যাপক ও অন্যান্য কিছু শিক্ষানুরাগী চাইছেন, প্রেসিডেিন্স যেরকম চলছে, তেমনই চলুক। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একই স্তরে নামিয়ে আনলে রবীনবাবু ও শম্ভুবাবু যেমন চাইছিলেন– সেটা যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয় এমন কথার কিন্তু সমর্থন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন প্রজাতন্ত্রের দিকে তাকালে পাওয়া যায় না। ওই সব জায়গাতেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। তার ফলেই সেখানে শিক্ষার মান গর্ব করার মতো। সাধারণ বাঙালিও তো প্রেসিডেিন্স নিয়ে একটু গর্ব অনুভব করতে পারেন! সেই কারণেই আমরা চাই, প্রেসিডেিন্স আবার স্বমহিমায় প্রতিিষ্ঠত হোক!

কাজে লাগানো হোক প্রাক্তনীদেরও
সুজয় মুখোপাধ্যায়
(অর্থনীতির অধ্যাপক
ল্বক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)

আমি প্রেসিডেিন্স কলেজে পড়েছি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত। অর্থনীতি অনার্স। এখনকার কথা সেভাবে বলতে পারব না। তবে আমরা যখন কলকাতার ওই প্রাচীন, ঐতিহ্যশালী কলেজটিতে পড়তাম, তখন সেখানকার অর্থনীতি বিভাগের মান ছিল বিেশ্বর যে কোনও সেরা কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনীয়। এমনকী এখন আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, সেই অক্সফোর্ডের সঙ্গেও চলে তার তুলনা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে পড়াশোনার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছোট ছোট কলেজকে কেন্দ্র করে টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা (টিউটস)। যার মূল মন্ত্র হল, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর প্রতি শিক্ষকদের আন্তরিক দৃিষ্ট, সহমর্মিতা। প্রেসিডেিন্স ভারতের গুটিকয়েক কলেজের অন্যতম যেখানে এই ট্রাডিশন চালু রয়েছে। এটা অক্সফোর্ডের ছাত্রশিক্ষক আকাদেমিক ঘনিষ্ঠতার পরিবেশের কথা মনে পড়িয়ে দেয় (আমাদের সময়ে তো বটেই)। হলফ করে বলতে পারি, স্নাতক স্তরে যে অমূল্য শিক্ষা আমি পেয়েছি, তার চালিকাশক্তি ছিলেন তিনজন সাধারণ শিক্ষক– অধ্যাপক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডি বি), মিহির রক্ষিত এবনবেন্দসেন। এঁরা ছিলেন অর্থনীতির দিকপাল শিক্ষক। অর্থনীতিতে দেশসেরা পণ্ডিতও। গভীর মেধামনন নিয়ে যুক্ত ছিলেন গুরুম্ভীর আকাদেমিক গবেষণায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তাপচা পাঠ্যক্রমের বাইরে গিয়ে যে ধরনের শিক্ষা তঁারা আমাদের দিয়েছেন, তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও শ্রমলব্ধ। দেশ বা বিদেশের যে কোনও সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ধরনের কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে। তঁাদের হাতেই বেড়ে উঠেছেন এমন কিছু অর্থনীতিবিদ, যঁারা বিশ্বজুড়ে হরেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলকৃত করে মেধার আলো ছড়াচ্ছেন। ওই সব শিক্ষকের আন্তরিক প্রেরণাই তো আমাদের উজ্জীবিত করেছিল।

গত কয়েক বছরে আমার পুরানো কলেজের অর্থনীতি বিভাগে কয়েকটা লেকচার দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। গেস্ট লেকচারার হিসাবে। আমার শিক্ষক প্রয়াত দীপক বন্দোপাধ্যায়ের উপদেশ, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অমিতাভ চেট্টাপাধ্যায় এব পুরানো বন্ধঅধ্যাপক অভিজিৎ দত্তের আমন্ত্রণে। আমাকে চমৎকৃত করেছে ছাত্রছাত্রীদের মান এবসিরিয়াস আকাদেমিক চর্চায় তঁাদের আগ্রহ। ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সময় যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। এটা বদলায়নি। কিন্তু তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ যে আমাদের তুলনায় ভিন্ন, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। জেনেছি, গত কয়েক বছরে এই ‘এলিট’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সমস্যায় জেরবার। তার সঙ্গে রয়েছে লাগাতার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এব আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের ফঁাস। প্রেসিডেিন্স বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রথমেই উচিত সেরা শিক্ষকদের সেখানে রেখে দেওয়া এবতার সঙ্গে সেরা শিক্ষকদের নিয়োগ করা। শিক্ষার মান বজায় রাখা বা বাড়ানোর জন্য এটা অত্যন্ত রুরি। তার পরেই আসবে পরিবেশ তৈরির কাজ। পড়াশোনার পরিবেশটা হওয়া উচিত আন্তরিক ও প্রথামুক্ত। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি যাতে গবেষণা ও বৌদ্ধিক চর্চায় যুক্ত থাকতে পারে, তার জন্য। কোনও ‘সেণ্টার অব এক্সলেন্স’এ এটাই দস্তুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা মেলার পর উপযুক্ত রসদ, রাজনীতি, আমলান্ত্রিকতা মুক্ত স্বাধীন পরিচালন ব্যবস্থার ব্যািপ্তর জোরে সেটাকে ওই রকম একটি ‘উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে গড়ে তোলা উচিত। আর রয়েছেন কলেজের হীরের টুকরো প্রাক্তনীরা। যঁাদের নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। এঁদেরও ঠিকঠাক ও সহত উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এই উদ্যোগটাই চাইছি আমি। আর তাকিয়ে আছি, প্রেসিডেিন্সর গৌরববৃদ্ধির যেজ্ঞ নিজেকে শামিল করার দিকে। যদি এই সাফল্যের সামান্য ভাগীদার আমিও হতে পারি!