Tuesday, December 8, 2009

তিন দশকের রাজত্বে সিপিএম শিক্ষাকেই সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করে গেল

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা না থাকলে দেশের দশের উন্নতি হয় না। শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ। ছোটবেলার রচনায় এমন সব লাইন যে কত বার লিখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। তখন এ সব যে খুব বুঝে জেনে লিখেছি, তা নয়। রচনা বই আর এ দিক সে দিক থেকে টুকে মুখস্থ করে পরীক্ষা পার হয়েছি। কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছি, আমাদের জীবনের সর্ব স্তরে শিক্ষার মূল্য কতখানি! উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া মানুষ কত অসহায়! এব, এটাও বুঝতে পেরেছি, একটা জাতকে পঙ্গু করে বশবদ বানাতে চাইলে তার শিক্ষার জগৎটাকে তছনছ করে দেওয়াই যথেষ্ট। অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিতের সখ্যা যত বাড়ে, মধ্যমেধা যত ছড়ায়, ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের তত সুবিধা। শিক্ষাগতভাবে দুর্বলদের বেশির ভাগই নিজের পর ভরসা রাখতে পারেন না। কিন্তু, তঁাদের নানাবিধ চাহিদা তো থাকেই। সেই চাহিদা পূরণ করতে তঁাদের অনেকেই চান একটা অবলম্বন। ক্ষমতাসীনরা নানান টোপ দিয়ে সহজেই এঁদের বাগে আনতে পারেন। এব, শর্টকাটে অনেক কিছু পাওয়ার লোভে কালক্রমে এঁরা ক্ষমতাসীন রাজনীতির ‘দাসে’ পরিণত হন। তখন এঁদের দিয়ে ক্ষমতাসীনরা কম কথায় অনেক ‘কাজ’ করিয়ে নিতে পারেন, ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে এঁদের ‘প্রোজেক্ট’ করে সমাজ এব সাধারণ মানুষের একটা বড় অশকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা দলে টানতে পারেন। তাতে, ক্ষমতায় টিকে থাকার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আর, সেই সঙ্গেই জাতির মেরুদণ্ডটি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। ক্ষমতাসীনদের অন্যায় কাজের সমালোচনা করা বা তঁাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা, প্রতিবাদ করার লোকের সখ্যাও একই অনুপাতে কমতে থাকে। ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া অধিকার, সর্বময় কর্তৃত্ব বিস্তারের পথটিও সুগম হয়ে যায়। কেবল, সিশ্লষ্ট জাতটা শিক্ষাগত দুর্বলতায় পিছিয়ে পড়তে থাকে সব দিক থেকে।

বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা নিয়ে বাম ফ্রণ্টের তথা সি পি এমের বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ দেখতে দেখতে আমার এই কথাগুলোই মনে হয়েছে। সত্তরের দশকে ক্ষমতায় আসার পর বাম ফ্রণ্ট যে তিনটি ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়েছিল, ‘শিক্ষা’ ছিল তার অন্যতম। বাকি দু’টি ছিল ভূমি সংস্কার ও স্বস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন। আমরা আজ সকলেই জানি, ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে বিনয় চৌধুরির মতো মানুষ থাকায় কিছুটা সাফল্য এই সরকার দেখাতে পারলেও দিনের পর দিন স্বস্থ্য পরিষেবার কী দশা করেছেন তঁারা! গত কয়েক দশকে স্বস্থ্য পরিষেবার হাল কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা আজ যে কোনও হাসপাতাল বা স্বস্থ্য কেন্দ্রে গেলেই বোঝা যায়। ডাক্তার নেই। থাকলেও তঁাকে অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। হাসপাতালের বেড পেতে দালাল ধরতে হয়। না হলে বেড পাওয়া যায় না। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নেই। দামি দামি মেশিন ঠিকঠাক দেখভালের অভাবে বছরের পর বছর খারাপ হয়ে পড়ে থাকে। সাফাইয়ের বালাই প্রায় নেই। ফলে চূড়ান্ত স্বস্থ্যকর পরিবেশেই চলে চিকিৎসার প্রহসন। মোদ্দা কথা, গোটা স্বস্থ্য ব্যবস্থাটাই কার্যত ভেঙে গিয়েছে। মন্ত্রীর পর মন্ত্রী এসেছেন, কিন্তু রাজ্যের স্বস্থ্যচিত্রটি বদলায়নি এতটুকু।

তবে, অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতা বদল হলে অন্য দল এসে এই ছবিটা বদলে দিতেও পারে। বলছি, যদি তঁাদের সদিচ্ছা থাকে, তা হলে আগামী দু’চার বছরে রাজ্যের স্বস্থ্য পরিষেবার চিত্রটা তঁারা বদলে দিতেই পারেন। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে সি পি এম বাম ফ্রণ্টের নামে যে ভয়কর সর্বনাশটা করে গেল, তা থেকে চট করে আমাদের মুক্তি দিতে কেউ পারবেন না। হাজার চেষ্টা করলেও না। কারণটা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষাটা তো আর কটা কলকবজা এবকিছু লোকজনের ব্যাপার না। শিক্ষা একটা সুশৃঙ্খল নিবিড় পরিকল্পনাসমৃদ্ধ ধারাবাহিক ব্যাপার। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সি পি এম শিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলা করতে গিয়ে তার মান এমন জায়গায় নামিয়ে এনেছে, এত অর্ধশিক্ষিত তৈরি করেছে এব তঁাদের অনেককে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য এমন সব পদে বসিয়ে দিয়েছে যে, গোটা ব্যাপারটাই আজ তালগোল পাকিয়ে গেছে। এই জট হয় তো চেষ্টা করলে খোলা যাবে। কিন্তু, যে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের শিক্ষার মেরুদণ্ড শুধু গবেষণা করতে গিয়ে তঁারা নড়বড়ে করে দিয়ে গেলেন, সেগুলো কীভাবে মজবুত করা যাবে?! কীভাবে সি পি এমের শিক্ষা সক্রান্ত হঠকারী সিদ্ধান্তগুলির মারাত্মক ফল বদলানো যাবে?!

আমরা জানি, মানুষ দেখে শেখে অথবা ঠেকে শেখে। সি পি এমের শিক্ষাবিদরা বা নেতারা, আমার মনে হয়, এ সব কিছুর বাইরে। বিশেষত, আমাদের সংস্কৃতিবান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো মনে হয় সব কিছুর ঊর্ধ্বে। Öখন যা ইচ্ছে হল করলাম, যখন যা ইচ্ছে হল বললাম। ঠিক না ভুল, কী এসে যায়? পার্টি আছে, সেবাদাসেরা আছেন। সব তঁারাই সামলে দেবেন। তবে কেবল বুদ্ধবাবুকে দোষ দিয়ে কী লাভ? এই জিনিস তো জ্যোতি বসুর আমল থেকেই চলছে। তঁার আমলেই তো আজকের মাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ দে এবমহামতি পবিত্র সরকারের মতো বিদ্বজ্জনরা মিলে হঠাৎ জিগির তুলেছিলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা চাই, ইরেজি হটাও....। রাজ্য জুড়ে এই জিগিরে শামিল করা হল রবীন্দ্রনাথকেও। লিখে লিখে সারা রাজ্য ছয়লাপ করে জানানো হল, কবিগুরুই বলে গিয়েছেন, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। মাতৃভাষায় শিক্ষাই আসল শিক্ষা। ইরেজি বিদেশি ভাষা। বড় হয়ে জানলেই হবে। না জানলেও ক্ষতি নেই। ‘মেহনতি’ মানুষের স্বার্থে সি পি এমের তৎকালীন প্রভুরা তুলে দিলেন ইরেজি। সারা দেশ, মায় সারা বিেশ্বর সঙ্গে যোগাযোগের সব চেয়ে সহজ মাধ্যম ইরেজি থেকে বিঞ্চত হতে লাগল রাজ্যের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। কর্তারা এক বারও ভাবলেন না রবীন্দ্রনাথ বলে যে মানুষটিকে তঁারা সাক্ষী মেনেছেন, তঁার বুদ্ধিশুদ্ধি, জ্ঞানবিদ্যে বা দূরদৃিষ্ট সি পি এমের বুদ্ধিজীবীপণ্ডিতদের থেকে কিছু বেশিই ছিল। মাতৃভাষা ছাড়া আর কিছু শেখার দরকার নেই, এমন কথা যে তিনি কোথাও বলেননি, সেটা খেঁাজ করার কথাও কারও মাথায় এল না! কাকে কান নিয়েছে, ছুটলেন সব কাকের পিছনে। কানটা কানের জায়গায় আছে কি না, তা দেখার কষ্টটুকুও করলেন না। তঁাদের এই অপার আলস্যের খেসারত দিল আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা। যঁাদের ক্ষমতা আছে তঁারা স্কুলের বাইরে ছেলেমেয়েদের পাড়ায় পাড়ায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ইরেজি কোচি সেণ্টারে পাঠালেন। নেতাদের ছেলেমেয়েরা বড় বড় ইরেজি মাধ্যম স্কুলে চলে গেল। মার খেল তারা, যাদের উন্নয়নের ধুয়া তুলে সি পি এম এই অপকর্মটি করল–সেই গরিব মেহনতি মানুষের ছেলেমেয়েরা। এব, সি পি এমের হাতে শিক্ষার সর্বনাশের সূত্রপাতও শুরু হল সেই দিন থেকে।

এর পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পÖর্ন্ত সর্বত্র সি পি এমের হরেক কানুন আর হরেক নীতির বলি হয়ে চলেছেন ছাত্রছাত্রীরা। কত বলব? প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়ে কী হচ্ছে, তা তো দেখছেন। পি টি টি আই পড়ুয়া এব পাশকরাদের এঁরা আজ ঠেলে দিয়েছেন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। বেশির ভাগ প্রাথমিক স্কুলে মাথার পর ছাদ নেই। ছাদ আছে তো শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছে তো ছাত্র নেই। মিড ডে মিলের চাল বাজারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর পোকায় কাটা চাল দেওয়া হচ্ছে বাচ্চাদের। খেয়ে তারা অনেক সময়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে! মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক নিয়ে তো দীর্ঘ দিনই চলছে রাজনীতি। এ বার এই জেলাকে তুলতে হবে, পরের বার ওই জেলা। কলকাতার সরকারিবেসরকারি নামী দামি স্কুলের মেধাবী ছেলেমেয়েরা সাধারণ নম্বর পেয়ে পাশ করছে, আর অখ্যাত স্কুলের ছেলেমেয়েরা পাচ্ছে বিশাল সব নম্বর। অনেকে তাতে এতটাই চমকে যাচ্ছে যে বলেই ফেলছে, কীভাবে পেলাম! এক বার মনে আছে, কয়েক বছর আগে একটি ছেলেকে প্রথম করতে উচ্চ মাধ্যমিকে হাজারে হাজারের প্রায় কাছাকাছি নম্বর দেওয়া হয়েছিল! কী কাণ্ড!

উচ্চ শিক্ষায় তো কথাই নেই। এ বার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ে তো পরের বার কমে! ভালো রেজাল্ট সব গ্রামে। শহরাঞ্চলে ভালো মেধারীরা যেন আজকাল থাকেই না। এ বার তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল এমন যে সি পি এমের ছাত্র সগঠন এস এফ আই পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হচ্ছে! যত দূর শুনেছি, এই ফলাফলে ছাত্রদের পড়াশোনা না করার ভূমিকা যতটা, তার চেয়ে খাতা মূল্যায়নের অপদার্থতাও কম নয়। অনেক পরীক্ষকই খাতায় এলোপাথাড়ি নম্বর দিচ্ছেন, অনেক সময় কারও দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড হয়েও নম্বর দেওয়া হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের কারও প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশেরও প্রতিফলন ঘটছে খাতার নম্বরে। এমনও দেখা যাচ্ছে, কেউ চারটি পেপারের দু’টিতে ৬০ শতাশের বেশি পেয়েছে, বাকি দু’টিতে মাত্র ৪০ শতাশ। এমন নম্বর দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তা হলে ওই পরীক্ষাথর্রী যথার্থ মান কোনটা? উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও বহু প্রশ্ন উঠে আসছে। গুণমানে যঁারা ভালো, তঁারা সুযোগ পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন মধ্যমেধাবীরা। ক্লাস হয়ে উঠছে নোট বিলির কেন্দ্র। ছাত্রছাত্রীরা বিষয় না বুঝে কেবল নোট মুখস্থ করতে প্ররোচিত হচ্ছে। সবই জানে সরকার। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বড় জোর হুংকার ওঠে কখনও কখনও। এই মাত্র।

তবে, বুদ্ধবাবুদের শিক্ষা নিয়ে খামখেয়ালিপনার চূড়ান্ত নিদর্শন হঠাৎ করে প্রেসিডেিন্স কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো। বিশ্বখ্যাত যে কলেজটা ক্রমশ শিক্ষাগত মানে নেমে চলেছে, তার মান উন্নয়নের জন্য বুদ্ধবাবুরা সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে দিলেন! ভাবুন কাণ্ডখানা! এর আগে বুদ্ধবাবুরা আরও দু’টো বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছেন, বারাসতে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় আর মালদহের গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমটি পরীক্ষা নিল। তার পর রেজাল্টও বার করল। সেই রেজােল্ট এত ভুল যে তা আবার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হল। আর দ্বিতীয়টির রেজােল্টর পাত্তাই নেই। বোঝাই যাচ্ছে, প্রেসিডেিন্সর ভবিষ্যৎ কী! আসলে সি পি এম যেটা চেয়েছিল, হয়ে গিয়েছে। বিরাট একটা প্রজন্মকে শিক্ষাগতভাবে তারা পঙ্গু করে দিতে পেরেছে। এখন বেকায়দায় পড়ে শিক্ষা ক্ষেত্রের বিরাট বিরাট গর্তগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজ বানিয়ে আড়াল করতে চাইছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে দরকার ছিল সুষ্ঠু শিক্ষানীতি আর শৃঙ্খলা। সেটা দেওয়ার ক্ষমতা আর বুদ্ধবাবুদের নেই। প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাজেত্ব শিক্ষা ক্ষেত্রেই সব চেয়ে বড় সর্বনাশটা করে গেল সি পি এম। সামলাতে কত বছর লাগবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।