Thursday, August 26, 2010

পরিবেশ বিপর্যয় ও সিএনজির মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গ

ড. তারেক শামসুর রেহমান


Published: 2010-07-14


বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে যখন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হচ্ছে, তখন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস বা সিএনজির দাম বাড়ানো হবে। আগামী রমজানের পরপরই এই মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর করা হবে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ। সিএনজি সাধারণত গাড়িতে ব্যবহৃত হয়। সরকার পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে গাড়িতে সিএনজি ব্যবহারে উৎসাহিত করেছিল। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত সেদিন প্রশংসিত হয়েছিল। গাড়িতে সিএনজি ব্যবহারের ফলে ডিজেল ও অকটেনের ব্যবহার হ্রাস পায়। এর মধ্য দিয়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনও কিছুটা হ্রাস পায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা বাড়ছে এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী বিশাল এক এলাকা সাগরগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, এখন সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির ফলে ডিজেল ব্যবহারের পরিমাণ বাড়বে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধিতে তা আরো সাহায্য করবে। যাঁরা সিএনজির মূল্য বৃদ্ধি করতে চাইছেন, তাঁরা কিছু বিষয় বিবেচনায় নেননি। প্রথমত, সিএনজির দাম বাড়িয়ে সরকারের রাজস্ব খুব একটা বাড়বে না। কেননা দেশে উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র ৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় এ খাতে। দ্বিতীয়ত, সিএনজির দাম বাড়ালে গাড়িতে ডিজেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। ফলে এই সেক্টরে কর্মরত প্রায় ২০ হাজার লোকের একটা বড় অংশ চাকরি হারাবে। কেননা দাম বাড়লে সিএনজির ব্যবহার কমে যাবে। দেশে ৫৬৫টি রি-ফুয়েলিং স্টেশন ও ১৬২টি রূপান্তর কারখানার অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে যাবে। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত ডিজেল ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে মারাত্দকভাবে এবং বিশ্ব আসরে বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। চতুর্থত, ডিজেল ব্যবহারের ফলে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে।

বাংলাদেশে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৯৮৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। আমদানির এ পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছেই। দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টন। আর আমদানি মূল্য ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ১২ লাখ টন অপরিশোধিত তেলের মূল্য তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা (প্রতি এক লাখ টনের দাম ২৫৫ কোটি টাকা হিসাবে) এবং অবশিষ্ট ২৫ লাখ টন পরিশোধিত তেলের মূল্য ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা (প্রতি এক লাখ টনের দাম ৩৭৫ কোটি টাকা হিসাবে)। তা ছাড়া প্রতি মাসে জ্বালানি তেল আমদানিতে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার দরকার হতো। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন দরকার এক হাজার ৬০০ কোটি থেকে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাড়তি দামের কারণে বিপিসির মাসিক লোকসানের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা। বিপিসি বেশি দামে তেল কিনে কম দামে বিক্রি করায় লোকসানও বাড়ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) খরচ ও দেনা বাড়ছে। প্রতি মাসে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করে বিপিসি। এতে যে অর্থ ব্যয় হয় তার মধ্যে ৪০ মিলিয়ন ডলার রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো নিজস্ব অর্থ থেকে পরিশোধ করে। ২৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয় আইডিবি ঋণ থেকে। বাকি ৮৫ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক ওডির মাধ্যমে পরিশোধ করে। এই পরিসংখ্যান ২০০৮ সালের।

অনেকের মনে থাকার কথা, ২০০৮ সালের শেষের দিকে পেট্রোবাংলা অর্থসংকট কাটাতে সরকারের কাছে এক হাজার ৯০৫ কোটি টাকা চেয়েছিল। পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় বিদেশি কম্পানিগুলো থেকে তারা তেল ও গ্যাস কিনতে পারছিল না। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে উচ্চ সুদে তাদের ঋণ নিতে হয়েছিল। আইডিবি থেকে নিতে হয়েছিল ২০০ মিলিয়ন ডলার আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে নিতে হয়েছিল ৩০ কোটি ডলার। সুদের হার ছিল ৫ দশমিক ৫৫ ডলার (আমার দেশ, ১৯ এপ্রিল, ২০০৮)। এখন সিএনজির দাম বাড়লে, খুব স্বাভাবিক কারণেই যাঁরা গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার করেন, তাঁরা আবার পেট্রল বা অকটেনে ফিরে যাবেন। এর ফলে চাহিদা বাড়বে। আর চাহিদা বাড়লে সরকারের আমদানিও বাড়বে। তাতে করে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণও বাড়বে। একপর্যায়ে ভর্তুকি কমাতে সরকারকে তেলের দাম বাড়াতে হবে, যা কিনা সামগ্রিক অর্থনীতিকে একটি নেতিবাচক প্রশ্নে ফেলতে পারে। প্রসঙ্গক্রমেই বলে রাখি, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও খাদ্য খাতে ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। শুধু তেল আমদানিতেই সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এটা আমাদের নিরাপত্তাকে যে কতটুকু ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

গত ছয় বছরে দেশে ১০ বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। ২০০৬ সালের ৮ জুন জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে অকটেন ৫৮ টাকা ও পেট্রল ৫৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর বর্তমানে অকটেন ও পেট্রল বিক্রি হয় যথাক্রমে ৭৭ ও ৭৪ টাকায়। এখন অকটেন বা পেট্রলের চাহিদা বেড়ে গেলে সরকারকে দাম বাড়াতে হবে, যা কিনা দেশের মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর (?) ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নতুন অস্থিরতা তৈরি হবে। মূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন কৃষকরা। কেননা জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হলে অকটেন, পেট্রলের পাশাপাশি ডিজেলের দামও বাড়াতে হবে। আর এটা করা হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে চরম সংকট তৈরি করবে। দেশে বর্তমানে ২৬ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। বোরো মৌসুমে প্রায় ৪৫ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ৩৩ লাখ হেক্টরে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রের মাধ্যমে ধান উৎপন্ন করা হয়। কৃষিতে ২৫ শতাংশ ডিজেল ব্যবহৃত হয়। বাকি ডিজেলের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পোড়ানো হয় পরিবহন খাতে।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩৮ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৯৮৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর হয়নি। প্রতিবছরই তেলের পেছনে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। সরকারি সূত্র অনুযায়ী ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ হয়েছিল ১৭০ কোটি ডলার। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ১৯৩ কোটি ডলার। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অর্থের পরিমাণ আরো এক ধাপ বেড়ে যায়। অর্থাৎ দিনে দিনে অর্থের পরিমাণ বাড়ছেই। ১৯৮৮ সালে জ্বালানি তেলের দাম ছিল মাত্র ১০ ডলার (ব্যারেল)। ২০ বছরের ব্যবধানে এ দাম ব্যারেলপ্রতি ১৪৬ ডলারে উঠলেও বর্তমানে তা কমে ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে অবস্থান করছে। তেলের দাম কমার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, যাতে করে মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে। ১৯৯৮ সালে বিশ্বে প্রতিদিন তেলের চাহিদা ছিল সোয়া দুই কোটি ব্যারেল। বর্তমান এ চাহিদা আট কোটি ব্যারেল ছাড়িয়ে গেছে। চীন ও ভারতের অর্থনীতির সমৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দুটি দেশের পক্ষে অধিক মূল্য দিয়ে জ্বালানি তেল কেনা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশ? বাংলাদেশের পক্ষে তো সম্ভব নয়।

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিরও একটা সম্পর্ক রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে, ফলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ শতাংশ। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়লে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাত থেকে বিনিয়োগ সরে যাবে। কেননা ভর্তুকি প্রত্যাহার করা নীতিগতভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কোনো রাজনৈতিক সরকারই ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে চায় না জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে। ২০০৮ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়া তেলের দাম ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছিল। ভারতও বাড়িয়েছিল; যার প্রতিবাদে ভারতে বামপন্থীদের আহ্বানে হরতাল পর্যন্ত হয়েছিল। সুতরাং আজ যাঁরা সিএনজির দাম বাড়িয়ে প্রকারান্তরে তেলের দাম বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে বাধ্য করছেন, তাঁদের এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এই মুহূর্তে সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের সুবিধাভোগী আমলারা অতীতে কোনোদিন জনস্বার্থে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুতরাং জনপ্রতিনিধিরা সিএনজির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখবেন, এটা আশা করছি।

আরো একটি কথা বিবেচনায় নিতে হবে, তা হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। গ্যাসের বদলে মানুষ যদি আবারও পরিবহনে আমদানিকৃত অকটেন ও ডিজেল ব্যবহার করে, তাতে করে পরিবেশ দূষণের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ বিশ্ব পরিবেশ দূষণের শিকার। বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহারের কারণে। জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল, গ্যাস ও কয়লা ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। আর এতে করে মরুর বরফ গলছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের বিশাল এলাকা আজ সমুদ্রের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার করে পরিবেশকে আরো দূষিত করতে পারে না। তাই কোনো অবস্থাতেই সিএনজির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। শত শত সরকারি গাড়িও এখন সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এখন দাম বাড়ানো হলে সুবিধাভোগীরা আবার গাড়িতে তেল ব্যবহারের যুক্তি তুলবেন। তাতে করে সরকারের খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে পরিবেশ দূষণ। বাংলাদেশ যেখানে আন্তর্জাতিক আসরে বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে তার ক্ষতির কথা বলছে, সেখানে পরোক্ষভাবে জ্বালানি তেল ব্যবহারের পরিমাণ বাড়িয়ে পরিবেশকে আরো দূষিত করতে পারে না। বিশ্বব্যাপী 'গ্রিন এনার্জি' ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে গ্রিন এনার্জি ব্যবহারকে সীমিত করে দেবে। আমি তাই মনে করি, সিএনজির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। বরং সিএনজি ব্যবহারের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রায় ষোল কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। নূ্যনতম জ্বালানি প্রাপ্তি আমাদের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে যদি আমরা আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাই, তা শুধু পরিবেশের দূষণের মাত্রা বাড়াবে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
(সুত্র,কালের কন্ঠ, ১৪/০৭/২০১০)