Thursday, August 26, 2010

আমেরিকায় পেট্রল ৩০ টাকা লিটার, এখানে নয় কেন

প্রবন্ধ ১...

আমেরিকায় পেট্রল ৩০ টাকা লিটার, এখানে নয় কেন

যদি আন্তর্জাতিক বাজারের দামে আমরা পেট্রল কিনতে না পারি, তা হলে ‘বিনিয়ন্ত্রণ’
নিয়ে ঢাক পিটিয়ে লাভ কী? কেন্দ্রীয় সরকারের পেট্রো-পণ্য নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন

সুগত মারজিৎ

বারের বর্ষায় ভাল বৃষ্টি হবে, এ রকম একটা আশা করলেও পেট্রল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এ দেশে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির হার খানিকটা বাড়িয়ে তুলবেই। সরকার বলছে, দেশে পেট্রলের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হল। তা হলে কি এ বারে বিশ্বের বাজারে তেলের দামের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও মূল্যস্তর নির্ধারিত হবে? বাইরে দাম বাড়লে দেশেও দাম বাড়বে, কমলে কমবে? সরকার একটা কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়। কম দামে পেট্রল-ডিজেল বিক্রি হলে দেশের তেল কোম্পানিগুলির প্রভূত ক্ষতি হয়, সরকারকে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়, শুধু শুধু অত ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মূলত রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিন কম দামে বিক্রি করার জন্য কোম্পানিগুলিকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এই ক্ষতি লাঘব করার জন্য তেলের দাম বাড়ানো প্রয়োজন।

উদারনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনে বাজারমুখী নীতির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সংস্কারের যুক্তি যে রকম যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, এগুলো যুক্তি নয়, অজুহাত। তেলের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের যে প্রভূত ক্ষতি হয়, ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধির হারকে উসকে দিয়ে সরকার সামগ্রিক ভাবে দেশকে যে সমস্যার মুখে দাঁড় করাচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সাফাই গাইবার জন্যই যেন ‘সংস্কার’, ‘বিনিয়ন্ত্রণ’, ‘ভর্তুকি হ্রাস’ ইত্যাদি অজুহাত খোলামকুচির মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি কমিটির রিপোর্টের কথাও বার বার শোনানো হচ্ছে, যে কমিটি দেশের ভিতরে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছে। মনে হতে পারে, আমরা বোধহয় ধীরে ধীরে সে দিকেই যাচ্ছি।

ভূমিশয্যা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ। নয়াদিল্লি, ২০১০। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা

সরকারের বাইরে বা ভিতরে যাঁরা তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করছেন, তাঁরা হয়তো সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়েই বেশি চিন্তিত। বিশেষ করে দিনের পর দিন খাদ্যদ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেল-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশে সরকারি ভাবে স্বীকৃত প্রায় ত্রিশ শতাংশ হতদরিদ্র মানুষকে কোন আশার বাণী শোনাবে, জানা নেই। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা সরিয়ে রাখলেও, নিতান্ত যুক্তির খাতিরে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কতটা নিয়ন্ত্রণহীন বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, সে বিষয়েও বিলক্ষণ সন্দেহের অবকাশ আছে।

অপরিশোধিত পেট্রলের মূল্য বিশ্বের বাজারে ২২ টাকার কাছাকাছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুচরো তেলের দাম সবচেয়ে বেশি ক্যালিফর্নিয়ায়— পরিশোধনের ব্যয়, পরিবহণ খরচ, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কর, সব নিয়ে তেলের দাম পড়ে লিটার প্রতি ৩০ টাকা মতো। হ্যাঁ, বিগত চার-পাঁচ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। বেড়ে হয়েছে লিটার প্রতি ৩০ টাকা। ডিজেলের দামও মোটামুটি ওই রকম। কেরোসিন বা রান্নার গ্যাসের উৎপাদন বা জোগানের খরচ এবং বাজার দামের মধ্যে আমাদের দেশে ফারাক আছে, তাই ভর্তুকির প্রয়োজন, সেটা বোঝা গেল। কিন্তু পেট্রলের দাম যে কী করে বিদেশের বাজারের সঙ্গে এক হয়ে এক নিয়ন্ত্রণহীন জমানার সূচনা করল সেটা বোঝা গেল না, যাবেও না কোনও দিন। মার্কিন মুলুকে পরিশোধন ও পরিবহণের খরচ আমাদের তুলনায় কম বলেই হয়তো সে দেশে পেট্রলের দাম ৩০ টাকায় রাখা গিয়েছে। কিন্তু একটা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে পেট্রলের ওপর লিটার প্রতি ২৫ টাকা মতো কর চাপানো হচ্ছে, আর ডিজেলের ওপর আমরা ১০ টাকার কাছাকাছি কর বসাচ্ছি।

অপরিশোধিত তেল বিদেশ থেকে আমদানির পর তা দেশের ভিতর বিক্রি করে দেশের তেল কোম্পানিগুলো। কোনটা বিশ্বের বাজারের ঠিক দাম, যদি সে দাম লিটার প্রতি ৩০ টাকার কাছাকাছি হয়, তা হলে নিয়ন্ত্রণ থাক বা না থাক, মানুষ কী সুবিধে পাচ্ছেন? কিছুই পাচ্ছেন না। আজ যদি বাইরের দাম ৩০ থেকে ২৫ টাকা হয়, সরকার ৫ টাকা কর বাড়িয়ে দেবেন। আমাদের ঘাড়ে যদি বিশাল করভার চাপিয়েই চলা হয়, তা হলে কী হিসেবে বলা হচ্ছে, দেশের ভিতরে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণহীন করা হল? তেলের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হল, এ কথা বলার কোনও যুক্তিই নেই, কারণ সরকার ইচ্ছে মতো কর চাপিয়ে সেই দাম নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। বিশ্বের বাজারে যদি ৩০ টাকা লিটার দরে তেল পাওয়া যায়, তা হলে আমরাও ওই দরে তেল কিনতে পারব— এটাই যথার্থ নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের পরিচায়ক। সরকার কোনও দিনই নিয়ন্ত্রণহীনতায় বিশ্বাস করে না। আর, তেল না কিনে মানুষের উপায় নেই, তাই সরকার যথেচ্ছ কর বসালেও মানুষ তা দিতে বাধ্য। সরকারের পোয়া বারো, প্রচুর রাজস্ব।

আর একটা কথা এখানে বলা দরকার। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে অনেক দিন সারা পৃথিবীতেই খাদ্যদ্রব্যের দাম বেশ কমে এসেছিল, অথচ আমাদের দেশে তা বেড়েছিল তরতর করে। সরকার যদি সত্যিই মুক্তবাণিজ্যে আস্থাভাজন হত, তা হলে খাবারদাবারের দাম কমে আসত খানিকটা। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসৃত হয়েছে, যাতে দেশের ভিতরে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসায়ীদের বেশি মুনাফা হয়। এটাই এটা অবাঞ্ছিত, কিন্তু এটাই হয়।

বিনিয়ন্ত্রিত উদারমনস্ক বাজারের চরম শত্রু একচেটিয়া কারবার, অর্থাৎ বাজারের ওপর একটি বা অল্প কয়েকটি কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করে দেওয়া নিয়ন্ত্রণের চরম উদাহরণ। আমাদের দেশে পেট্রোপণ্যের বাজারের অবস্থা ঠিক ওই রকম। প্রতিযোগিতা থাকলে বিদেশের অনেক কোম্পানি এখানে তেল বিক্রি করত। এক সময় কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বিদেশি তেল কোম্পানি ছিল। এতই যদি ‘মুক্ত বাণিজ্য’ বলে উল্লম্ফন, তা হলে প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায় না কেন? যায় না, কারণ তা হলে এ দেশের সরকারি এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলোর এত রমরমা হত না। মার্কিন মুলুকে দু’চার মাইলের মধ্যে অবস্থিত পেট্রল-ডিজেলের স্টেশনের মধ্যে দামের ফারাক হতেই পারে। কারণ— প্রতিযোগিতা। আমরা এতটাই হতভাগ্য যে জানতেই পারি না, আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো এমন সংরক্ষিত বাজারে, এত শিশুসুলভ সুরক্ষার মধ্যে থাকলেও কেন মুনাফা করতে পারে না। গাদা গাদা ঐরাবত পুষে আমরা দেশের কী উপকার করছি? সরকারি তেল কোম্পানিগুলির অদক্ষতা, অনাবশ্যক খরচ করার প্রবণতা, দুর্নীতির সংকেত, এ সব নিয়ে কি আমরা কোনও শ্বেতপত্র দেখেছি? এটা কি ঠিক যে, যদি কোনও কর না থাকত, কোনও ভর্তুকি না থাকত, কোনও হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ না থাকত, তা হলে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো ৩০ টাকা লিটার দরে পেট্রল বিক্রি করত? যদি না করতে পারত, তা হলে জানা উচিত, তাদের উৎপাদন এবং পরিষেবার খরচ বিশ্বের বাজারের তুলনায় কতটা বেশি এবং কার দোষে তা বেশি।

এ বার দেখা যাক, নিয়ন্ত্রণহীন তেলের বাজার কেমন হওয়া উচিত, সে জন্য পেট্রোপণ্যের যথাযথ নীতিই বা কেমন হওয়া দরকার। এখানে রাজনীতির কোনও জায়গা নেই, অর্থনীতির যুক্তিটাই একমাত্র কথা।

(১) প্রথমে পূর্ণ প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। স্বদেশি বিদেশি অনেক কোম্পানি দেশে তেল বিক্রি করতে পারবে। তাতে পেট্রল-ডিজেলের দাম কী হয়, সেটা দেখতে হবে।

(২) সরকার যদি রান্নার গ্যাস, কেরোসিন বা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে চায়, তা হলে স্বদেশি এবং বিদেশি, সব কোম্পানিই তা পাবে। যদি সরকার কর বাড়াতে চায়, তা হলেও সব কোম্পানির ওপর তা সমান ভাবে বসবে।

(৩) সরকারি কোম্পানিগুলি ভর্তুকি ছাড়া চালানো না গেলে দেখতে হবে কেন তারা এত অদক্ষ। প্রয়োজনে তাদের কলেবর কমাতে হবে। বিদেশি কোম্পানির প্রতিযোগিতা থাকলে দেশের কোম্পানিগুলিও সতর্ক হবে।

(৪) মানুষের পেট্রোপণ্য না কিনে উপায় নেই বলে সরকার যথেচ্ছ কর বসাবে, এটা যুক্তির কথা হতে পারে না। দেখতে হবে, অন্য কোথায় কর ছাড় বন্ধ করে বা কমিয়ে পেট্রোপণ্যের কর কমানো যায়। এখানে প্রতিবাদীদেরও দায়িত্ব আছে। আজ ডিজেল, কেরোসিন বা রান্নার গ্যাসের দাম কমানোর যে দাবি বিরোধী এবং সরকার পক্ষের দলগুলো করছে, সেটা অনেক বেশি কার্যকর হবে যদি তারা দেখাতে পারে, অন্য কোথায় কর ছাড়ের মাত্রা কমানো যেত। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার বোঝানো যাবে।

অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীরা জানেন, সাম্প্রতিক কালে ভারতের শিল্পে তেমন মন্দা আসেনি। বিশ্ব অর্থনীতির চরম মন্দার সময়েও আমরা বেশ ভাল ফল করেছি। এর পিছনে সরকারি সহযোগিতার একটা বড় ভূমিকা আছে। গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার শিল্পকে পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে ষাট হাজার কোটি টাকা ছাড় দিয়েছিল। পাশাপাশি, কৃষিতে প্রচুর ঋণ মকুব করা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, অতি দরিদ্র কৃষকরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পান না, ঋণ নেন এবং পান প্রধানত মাঝারি অবস্থার কৃষিজীবীরা। অর্থাৎ, কৃষি ও শিল্পে সরকার যে সহযোগিতা করেছিল, যথার্থ দরিদ্ররা তার সুফল বিশেষ পাননি। যদি ওই সহযোগিতার অঙ্ক কমিয়ে সেই পরিমাণ টাকাটা কেরোসিন, রান্নার গ্যাস বা ডিজেলের দামে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া হত, তা হলে বোঝা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। শিল্পে যা কর-ছাড় দেওয়া হয়েছিল, জিনিসপত্রের দামে তার কোনও প্রভাব পড়েছিল কি না জানা নেই। যদি তা না হয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে কেবল শিল্পপতিদের মুনাফাই বেড়েছিল। তা হলে, যে মানুষটা একটা ছোট ম্যাটাডর চালিয়ে শহরে তরিতরকারি পৌঁছে দেন, তাঁর ডিজেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের কোন উপকারটা হল?

লেখক অর্থনীতিবিদ, কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত

No comments: