Sunday, December 13, 2009

প্রেসিডেিন্সর হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনবে?

সাতের দশক থেকেই ক্রমশ প্রেসিডেিন্স কলেজের স্বাতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণ করার সগঠিত আয়োজন চলেছে। সম্প্রতি প্রেসিডেিন্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপ কি প্রেসিডেিন্সহৃতগৌরব ফিরিয়ে আনবে? আলোচনা করেছেন দুই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।

অতীন্দ্রমোহন গু
( বিশিষ্ট পরিসখ্যানবিদ, প্রেসিডেিন্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক)

প্রেসিডেিন্স কলেজের বয়স প্রায় ২০০ বছর হতে চলল। ১৮১৭ সালে হিন্দ কলেজ নাম নিয়ে এর যাত্রা শুরু। তখন সেখানে পড়তে পারত শুধু হিন্দ ম্ভ্রন্ত পরিবারের পুত্র সন্তানরা। আর সেটি ছিল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ১৮৫৫ সালে এটি সরকারের হাতে চলে যায়। হিন্দকলেজের সিনিয়র অশ প্রেসিডেিন্স কলেজ নাম গ্রহণ করে, জুনিয়র অশ হয় হিন্দু স্কুল। প্রেসিডেিন্স কলেজের দরজা তখন থেকেই অন্য সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যও খুলে যায়। বহু বছর পর ১৯৪৪ সাল থেকে ছাত্রীদেরও ভরতি করা হতে থাকে। তার দীর্ঘ ইতিহাসে প্রেসিডেিন্স কলেজে নানা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই এখানে পঠনপাঠনের মান উঁচু ছিল। িব্রটিশ আমলেও যেমন, স্বাধীনতাপরবতর্ী সময়েও তেমনি, উৎকৃষ্ট শিক্ষকমণ্ডলী ও গবেষকদের কল্যাণে প্রেসিডেিন্স ক্রমে প্রাচ্যের অক্সিব্রজ হিসেবে খ্যাতিলাভ করে। কলেজের বিতর্কসভা, সেমিনার, বার্ষিক পত্রিকা– সব কিছুর মধ্যেই বিশিষ্টতার ছাপ থাকত।

প্রেসিডেিন্সর ইতিহাস বিগত শতকের সাতের দশক পর্যন্ত উত্তরোত্তর উন্নতির ইতিহাস। সাতের দশকের শেষভাগে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কলেজ কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। শাসকদলের নেতারা বলতে আরম্ভ করেন, অন্য কলেজ বিঞ্চত হবে, আর প্রেসিডেিন্স মাথা উঁচু করে থাকবে– এটা তঁাদের সমাজবাদী ধ্যানধারণাতে চলতে পারে না। দুই নেতা, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এব শিক্ষামন্ত্রী শম্ভু ঘোষ তো জোর গলায় বত্মেছিত্মেন, তঁাদের কাছে প্রেসিডেিন্স ও অন্য কলেজের স্থান একই স্তরে। তাই প্রেসিডেিন্স যেসব সুযোগসুবিধা পেয়ে এসেছে সেগুলি আেস্ত আেস্ত কমিয়ে আনা হবে।

এর প্রথম লক্ষণ দেখা গেল যখন প্রেসিডেিন্সর নামী অধ্যাপকদের অনেককে মফস্‌সলের কলেজে বদলি করা হল এবতঁাদের স্থানে অপেক্ষাকৃত নিম্ন মানের শিক্ষকদের কলেজে নিয়ে আসা হল। ফলে নামী অধ্যাপক অনেকে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন, অনেকে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। কেউ কেউ বা অপেক্ষাকৃত ভালো বেসরকারি কলেজে যোগ দিলেন। এভাবে প্রেসিডেিন্স কলেজের পঠনপাঠন অনেকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হল। নতুন অধ্যাপকরা অনেকে রাজনীতিতে বেশি সময় ব্যয় করতেন, অধ্যাপনার কাজ তঁাদের কাছে গৌণ হয়ে দঁাড়াল। প্রেসিডেিন্স কলেজের একটা বৈশিষ্ট্য হল ভরতির পরীক্ষা। তঁারা বার বার চেষ্টা করলেন, এ পরীক্ষা তুলে দেওয়ার। ছাত্রছাত্রীদের বাধা দানের ফলে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু যেটা বড় কথা প্রবীণ শিক্ষকরা নতুন শিক্ষকদের খানিকটা ভয়ের চোখে দেখতেন। স্বভাবতই প্রেসিডেিন্সর শিক্ষাগবেষণার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হল। পরীক্ষার ফল হয়তো তেমন খারাপ হল না, কারণ প্রেসিডেিন্সর ছাত্রছাত্রীদের মেধা যে আগের চেয়ে কমে গেল তা নয়। সেই মেধার জোরে এবপ্রবীণতর শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে তারা পরীক্ষায় অনেকটা আগের মতোই ভালো ফল করতে লাগল। তবে অতি সম্প্রতি এই দিকটাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে আরম্ভ করেছে। গবেষণার কাজ অনেক বিভাগে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

আমরা যারা একই সঙ্গে প্রেসিডেিন্সর প্রাক্তন ছাত্র এব শিক্ষক, তারা কলেজের দুরবস্থা লক্ষ করে চেষ্টা করেছি সীমিত ক্ষমতা নিয়ে বাধাদানের জন্য। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে, প্রচার পুিস্তকা বের করে সাধারণ মানুষকে প্রেসিডেিন্সর সকট সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়াস নিয়েছি। একবার অবসরপ্রাপ্ত অশীতিপর চার অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সুশোভনচন্দ্র সরকার, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ও ভবতোষ দত্ত আমাদের অনুরোধে প্রেসিডেিন্সর অসুবিধা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে মহাকরণে গিয়েছিলেন। জ্যোতিবাবু তঁাদের স্পষ্টই বলেছিলেন, দলের দিক থেকে বাধা আছে, তাহলেও তিনি চেষ্টা করবেন দেখতে প্রেসিডেিন্সর জন্য কী করা যেতে পারে। এতে অবশ্য অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

আমাদের দৃিষ্ট পড়েছিল ইউ জি সি’র প্রস্তাবিত অটোনমাস কলেজ ধারণাটির উপর। অটোনমাস কলেজ হলে প্রেসিডেিন্স ছাত্রছাত্রী নির্বাচনে, শিক্ষকশিক্ষিকা নিয়োগে, পরীক্ষাগ্রহণ ও তার ফল প্রকাশে স্বাধীনতা পাবে। সঙ্গে সঙ্গে ইউ জি সি’র অনুদানের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। আমরা এটা নিয়ে কিছু সভাসমিতিতে বলেছি, প্রচারপুিস্তকা বের করেছি। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, আমরা বিশেষ সফল হইনি। বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন শিক্ষা সম্পর্কে যেসব প্রতিবেদন বের করেছেন যেমন, উদগঁাওকর কমিটি, গণি কমিটি, ভবতোষ দত্ত কমিশন ইত্যাদিতে অটোনমির স্বপক্ষে জোর সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেিন্সর প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের দৃিষ্টভঙ্গির বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা এটা লক্ষ করে শঙ্কিত যে অনেক বিভাগের শূন্যপদ পূরণ করার ব্যাপারে সরকার গড়িমসি করছে। উচ্চতর পদ খালি রেখে তার পরিবর্তে নিম্নতর পদে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে।

এই পটভূমিতেই সম্প্রতি প্রেসিডেিন্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। সেই ঘোষণায় আমরা আনন্দিত। বিশ্ববিদ্যালয় হলে অটোনমির সুবিধাগুলি তো পাওয়া যাবেই, তদুপরি প্রেসিডেিন্স তার কাজকর্ম প্রসারিত করার একটা বড় সুযোগ পাবে। ইউ জি সি’র কাছ থেকে অনুদান অনেক বেশি মাত্রায় পাওয়া যাবে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা যাবে। স্নাতকনিম্ন স্নাতকোত্তর উভয় দিকের পঠনপাঠন ও গবেষণায় দৃিষ্ট দেওয়া যাবে। গ্রন্থাগারের জন্য নবপ্রকাশিত বই ও জার্নাল কেনা যাবে। ন্নতি হবে ত্ম্যাবরেটরিরও।

তদুপরি সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের কাছে সব ব্যাপারে নির্ভরতা থেকে প্রেসিডেিন্স মুক্ত হবে। এখন প্রেসিডেিন্সর কোনও শিক্ষক যদি সেমিনার, সিেম্পাজিয়ামে যেতে চান– দেশেই হোক বা বিদেশেই হোক, তাহলে শিক্ষা দপ্তরের কাছে তঁাকে বারে বারে গিয়ে তদ্বির করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলে এই যন্ত্রণা ও হয়রানি থেকে মুক্ত থাকা যাবে। পরীক্ষাগ্রহণ ও তার ফল ঘোষণা অনেক তাড়াতাড়ি করা যাবে।

আমরা এটা লক্ষ করে অবাক হচ্ছি যে কিছু অধ্যাপক ও অন্যান্য কিছু শিক্ষানুরাগী চাইছেন, প্রেসিডেিন্স যেরকম চলছে, তেমনই চলুক। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একই স্তরে নামিয়ে আনলে রবীনবাবু ও শম্ভুবাবু যেমন চাইছিলেন– সেটা যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয় এমন কথার কিন্তু সমর্থন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীন প্রজাতন্ত্রের দিকে তাকালে পাওয়া যায় না। ওই সব জায়গাতেও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। তার ফলেই সেখানে শিক্ষার মান গর্ব করার মতো। সাধারণ বাঙালিও তো প্রেসিডেিন্স নিয়ে একটু গর্ব অনুভব করতে পারেন! সেই কারণেই আমরা চাই, প্রেসিডেিন্স আবার স্বমহিমায় প্রতিিষ্ঠত হোক!

কাজে লাগানো হোক প্রাক্তনীদেরও
সুজয় মুখোপাধ্যায়
(অর্থনীতির অধ্যাপক
ল্বক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)

আমি প্রেসিডেিন্স কলেজে পড়েছি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত। অর্থনীতি অনার্স। এখনকার কথা সেভাবে বলতে পারব না। তবে আমরা যখন কলকাতার ওই প্রাচীন, ঐতিহ্যশালী কলেজটিতে পড়তাম, তখন সেখানকার অর্থনীতি বিভাগের মান ছিল বিেশ্বর যে কোনও সেরা কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনীয়। এমনকী এখন আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, সেই অক্সফোর্ডের সঙ্গেও চলে তার তুলনা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে পড়াশোনার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছোট ছোট কলেজকে কেন্দ্র করে টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা (টিউটস)। যার মূল মন্ত্র হল, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর প্রতি শিক্ষকদের আন্তরিক দৃিষ্ট, সহমর্মিতা। প্রেসিডেিন্স ভারতের গুটিকয়েক কলেজের অন্যতম যেখানে এই ট্রাডিশন চালু রয়েছে। এটা অক্সফোর্ডের ছাত্রশিক্ষক আকাদেমিক ঘনিষ্ঠতার পরিবেশের কথা মনে পড়িয়ে দেয় (আমাদের সময়ে তো বটেই)। হলফ করে বলতে পারি, স্নাতক স্তরে যে অমূল্য শিক্ষা আমি পেয়েছি, তার চালিকাশক্তি ছিলেন তিনজন সাধারণ শিক্ষক– অধ্যাপক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডি বি), মিহির রক্ষিত এবনবেন্দসেন। এঁরা ছিলেন অর্থনীতির দিকপাল শিক্ষক। অর্থনীতিতে দেশসেরা পণ্ডিতও। গভীর মেধামনন নিয়ে যুক্ত ছিলেন গুরুম্ভীর আকাদেমিক গবেষণায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তাপচা পাঠ্যক্রমের বাইরে গিয়ে যে ধরনের শিক্ষা তঁারা আমাদের দিয়েছেন, তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও শ্রমলব্ধ। দেশ বা বিদেশের যে কোনও সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ধরনের কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে। তঁাদের হাতেই বেড়ে উঠেছেন এমন কিছু অর্থনীতিবিদ, যঁারা বিশ্বজুড়ে হরেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলকৃত করে মেধার আলো ছড়াচ্ছেন। ওই সব শিক্ষকের আন্তরিক প্রেরণাই তো আমাদের উজ্জীবিত করেছিল।

গত কয়েক বছরে আমার পুরানো কলেজের অর্থনীতি বিভাগে কয়েকটা লেকচার দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। গেস্ট লেকচারার হিসাবে। আমার শিক্ষক প্রয়াত দীপক বন্দোপাধ্যায়ের উপদেশ, বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক অমিতাভ চেট্টাপাধ্যায় এব পুরানো বন্ধঅধ্যাপক অভিজিৎ দত্তের আমন্ত্রণে। আমাকে চমৎকৃত করেছে ছাত্রছাত্রীদের মান এবসিরিয়াস আকাদেমিক চর্চায় তঁাদের আগ্রহ। ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সময় যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। এটা বদলায়নি। কিন্তু তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ যে আমাদের তুলনায় ভিন্ন, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। জেনেছি, গত কয়েক বছরে এই ‘এলিট’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সমস্যায় জেরবার। তার সঙ্গে রয়েছে লাগাতার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এব আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের ফঁাস। প্রেসিডেিন্স বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রথমেই উচিত সেরা শিক্ষকদের সেখানে রেখে দেওয়া এবতার সঙ্গে সেরা শিক্ষকদের নিয়োগ করা। শিক্ষার মান বজায় রাখা বা বাড়ানোর জন্য এটা অত্যন্ত রুরি। তার পরেই আসবে পরিবেশ তৈরির কাজ। পড়াশোনার পরিবেশটা হওয়া উচিত আন্তরিক ও প্রথামুক্ত। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি যাতে গবেষণা ও বৌদ্ধিক চর্চায় যুক্ত থাকতে পারে, তার জন্য। কোনও ‘সেণ্টার অব এক্সলেন্স’এ এটাই দস্তুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা মেলার পর উপযুক্ত রসদ, রাজনীতি, আমলান্ত্রিকতা মুক্ত স্বাধীন পরিচালন ব্যবস্থার ব্যািপ্তর জোরে সেটাকে ওই রকম একটি ‘উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে গড়ে তোলা উচিত। আর রয়েছেন কলেজের হীরের টুকরো প্রাক্তনীরা। যঁাদের নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। এঁদেরও ঠিকঠাক ও সহত উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এই উদ্যোগটাই চাইছি আমি। আর তাকিয়ে আছি, প্রেসিডেিন্সর গৌরববৃদ্ধির যেজ্ঞ নিজেকে শামিল করার দিকে। যদি এই সাফল্যের সামান্য ভাগীদার আমিও হতে পারি!

No comments: